শনিবার , ২৫শে অক্টোবর, ২০২৫ ইং || ৯ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - হেমন্তকাল || ৩রা জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরী

ত্রিশালে জুয়া ও নেশায় আসক্ত ছেলের হাতে বাবা-মা খুন মা বাবার নিজ রুমের মেঝেতে পুঁতে রেখেছিল মরদেহ

প্রকাশিত হয়েছে-

হানিফ আকন্দ,ত্রিশাল প্রতিনিধি:: ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ঘটেছে এক হৃদয়বিদারক ও নৃশংস পারিবারিক হত্যাকাণ্ড। জুয়া ও নেশার টাকার জন্য বখাটে ও আসক্ত ছেলে রাজু (২৫) নিজের জন্মদাতা বাবা-মাকে হত্যা করে ঘরের মেঝেতে পুঁতে রাখে বাবার নিজ রুমে।হত্যার পর ঘটনাটি গোপন রাখতে সে মানুষের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে ঘাতক ছেলে। কিন্তু ৯ই অক্টোবর ২৫ইং। বৃহস্পতিবার দিন প্রতিবেশীদের সন্দেহের কারণে বেরিয়ে আসে এই ভয়ংকর সত্য। ঘটনাটি ঘটেছে ত্রিশাল উপজেলার বৈলর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের বৈলর বাশকুঁড়ি গ্রামে। নিহতরা হলেন— মোহাম্মদ আলী শেখ (৬৫) ও তাঁর স্ত্রী বানু বেগম (৫৫)। তারা এলাকার অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও সৎ দম্পতি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্থানীয়দের ভাষায়, “এমন মানুষকে হত্যা করবে ছেলে তা কেউ ভাবতেও পারেনি।” পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজু দীর্ঘদিন ধরে জুয়া ও নেশায় অনলাইনে আসক্ত ছিল। সে নিয়মিত মোবাইল ফোনে অনলাইন ক্যাসিনো ও জুয়া ও নেশার টাকার জন্য সে তার বাবা-মাকে প্রায়ই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত।কিছুদিন আগে রাজু তার বাবাকে জোর করে জমি বিক্রি করিয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। কিন্তু সেই টাকা শেষ হওয়ার পরও তার লোভ মেটেনি। আবারও বাবার কাছ থেকে টাকা দাবি করে, ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ত্রিশাল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনসুর আহাম্মদ জানান, “আটক রাজু প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। তার জবানবন্দি অনুযায়ী, গতকাল ৮ই অক্টোবর বুধবার দুপুরে সে প্রথমে তার মাকে গলা টিপে শ্বাসরোধে হত্যা করে। পরে গভীর রাতে, প্রায় দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে, কুড়াল দিয়ে বাবার মাথায় আঘাত করে হত্যা করে।” এরপর হত্যার বিষয়টি গোপন রাখতে রাজু তার বাবার রুমের মেঝে খুঁড়ে প্রায় ৭ ফুট গভীর গর্ত তৈরি করে, সেখানে বাবা-মায়ের মরদেহ একসাথে পুঁতে রাখে। গর্তের উপর মাটি সমান ও একটি ট্রাংএর উপর বিছানা সাজিয়ে রাখে সে যেন কিছুই ঘটেনি এমন আচরণ করতে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দা মফিজ উদ্দিন হোসেন (৪৫) বলেন, “মোহাম্মদ আলী সাহেব নিয়মিত মসজিদে নামাজ পড়তেন। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার ফজর ও জোহরের নামাজে তাঁকে দেখা যায়নি। এতে পরিবারের আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়। এরপর সবাই মিলে বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে রাজুর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে পুলিশে খবর দেই।” অন্য এক প্রতিবেশী আবুবক্কর ছিদ্দিক বলেন, “আগের রাতেও মুহাম্মদ আলী শেখ এর সাথে আমরা একসাথে বসে চা খেয়েছি। এমন মানুষকে হত্যা করতে পারে— এটা কল্পনাতেও আসেনি। সে যেন মানুষের মুখোশে এক দানব।” পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে রাজুকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে রাজু হত্যার কথা স্বীকার করে ফেলে। তার দেখানো স্থান অনুযায়ী পুলিশ সেখান থেকে তার ঘরের বাবার রুমের মেঝ খুঁড়ে দুটি মরদেহ উদ্ধার করে। মরদেহগুলো উদ্ধারকালে উপস্থিত এলাকাবাসীর অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ওসি মনসুর আহাম্মদ বলেন, “এটি অত্যন্ত নৃশংস ও শিহরণ জাগানো একটি হত্যাকাণ্ড। অভিযুক্ত রাজুর বিরুদ্ধে দ্বৈত হত্যা মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।” এই নৃশংস ঘটনার পর বৈলর বাশকুঁড়ি গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে গভীর শোক ও ক্ষোভের ছায়া। নিহত দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলে ছিল। সবাই বিবাহিত এবং মেয়েরা স্বামী বাড়ি বসবাস করতেন। তারা খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন।স্থানীয়দের বক্তব্য, “এমন ছেলের জন্ম যেন আর না হয়। যে নিজের মা-বাবাকে মেরে ফেলতে পারে, সে মানুষ নয়— সে এক ভয়ংকর দানব।” স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, জুয়া, নেশা ও অনলাইন গেমের ভয়ংকর আসক্তি সমাজের জন্য এক অশনিসংকেত হয়ে উঠেছে। এই ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ হলো, প্রযুক্তি ও নেশার অপব্যবহার কীভাবে একটি পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। “এ ধরনের অপরাধ রোধে এখনই সামাজিক আন্দোলন দরকার। পরিবার ও সমাজকে সচেতন হতে হবে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে অনলাইন জুয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।” ত্রিশালের এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবারের নয়— এটি পুরো সমাজের জন্য এক সতর্কবার্তা। জুয়া, নেশা ও অনলাইন আসক্তির মতো সামাজিক ব্যাধি এখন ঘরে ঘরে প্রবেশ করছে, আর তার পরিণতি হচ্ছে এমন ভয়ংকর ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। বৈলর বাশকুঁড়ি গ্রামের এই হত্যাকাণ্ড যেন হয়ে থাকে—
“অসচেতনতার মূল্য কত ভয়াবহ হতে পারে”— তার নির্মম সাক্ষী।