এক মহানায়কের প্রস্থান ও কালিমালিপ্ত জাতি

হাফিজুর রহমান::
আমার চোখে বাঙালি জাতির জনক বাংলাদেশ নামক একটি দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও বাস্তবায়নকারী বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একজন ব্যক্তিই নন তিনি একটি ইন্সটিটিউট যেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারেন বিশ্ব নেতারা। বাঙালি হয়ে একদিকে জাতির পিতাকে নিয়ে আমি গর্বিত অন্যদিকে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের ঘাতকরাও বাঙালি হবার কারণে আমি লজ্জিত। একটি জাতি কি করে এমনটা করতে পারে? এই প্রশ্ন আমার এবং বিশ্ববাসীর। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করে যদি মনে করা হয় তাঁর পরিবারের ক্ষতি করা হয়েছে তবে ঘাতকদের চিন্তা ভুল কারণ জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্ববাসীর কাছে অকৃতজ্ঞ ও কালিমালিপ্ত জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচিত করিয়েছি। কতটা নির্মম হলে একটি মানুষের গোটা পরিবারকে হত্যা করা হতে পারে? তিনি শুধু একজন ব্যক্তিই ছিলেন না তিনি ছিলেন এক রাষ্ট্র ও জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় তথা বাংলাদেশের জন্ম ও সাফল্যের মূলে যার অবদান সবার ঊর্ধ্বে, তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
অবিসংবাদিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু বাঙালির জাতীয় চেতনার এক প্রজ্বলিত শিখা। তিনি ছিলেন সমগ্র বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের অগ্রনায়ক। হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তার সুদক্ষ ও সফল নেতৃত্বের ফসল হচ্ছে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাল-সবুজের একটি পতাকা। পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে বাঙালি জাতির নিজস্ব পরিচয় ও ঠিকানা।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ একটি মহাকাব্য। আর এ মহাকাব্যের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালির জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা। এ আদর্শেই তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। সারা জীবন আন্দোলন-সংগ্রাম ও লড়াই করে তিনি বাঙালির স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য আমাদের, বাঙালি জাতির! আজীবনের স্বপ্নের সেই স্বাধীন বাংলাদেশেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকের দল।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় তথা বাংলাদেশের জন্ম ও সাফল্যের মূলে যার অবদান সবার ঊর্ধ্বে, তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি তেজস্ক্রিয় পদার্থের ন্যায় ঝলসে উঠেছিলেন এবং তার এই তেজোদীপ্ত অবদানের কারণে তিনি পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরে ১৪ বার গ্রেপ্তার, প্রায় ১৩ বছর রাজনৈতিক কারণে কারাবরণ এবং দুইবার ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছেন। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিল প্রায় সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি আমাদের একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, তাই সমকাল তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদা।
অবিসংবাদিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু বাঙালির জাতীয় চেতনার এক প্রজ্বলিত শিখা। তিনি ছিলেন সমগ্র বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের অগ্রনায়ক। হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তার সুদক্ষ ও সফল নেতৃত্বের ফসল হচ্ছে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাল-সবুজের একটি পতাকা। পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে বাঙালি জাতির নিজস্ব পরিচয় ও ঠিকানা। এই মহান ত্যাগী ও সংগ্রামী নেতা সম্পর্কে এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরা সত্যিই কঠিন। নতুন প্রজন্মের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি; কিন্তু ইতিহাসের পাতা বিশ্লেষণ করে আমরা এই মহান নেতার জীবন ও আদর্শ থেকে এটাই উপলব্ধি করতে পারি যে, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটত না। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগ্রামী জীবন, সাহস, নেতৃত্ব, ত্যাগ ও মানবিক গুণাবলি লিখে কখনও শেষ করা যাবে না। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দিশারি, এক আপসহীন নেতা ও রাজনীতিবিদ।
এ কারণেই বিখ্যাত পত্রিকা ‘নিউজ উইক’ বঙ্গবন্ধুকে এক অনন্য ‘সুপারম্যান’ ও ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। তার সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিক সিরিল ডান বলেছেন, ‘বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা, যিনি রক্ত-বর্ণ, ভাষা-কৃষ্টিতে এবং জন্মসূত্রেও ছিলেন খাঁটি বাঙালি। জনগণকে নেতৃত্বদানের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সাহস তাকে এ যুগের এক বিরল মহানায়কে রূপান্তর করেছে।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দর্শন ছিল ব্যতিক্রম ও প্রগতিশীল। তিনি বাঙালির নাড়ির স্পন্দন, আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতেন। তার এ উপলব্ধি পরবর্তী সময়ে বাঙালির আকাঙ্ক্ষার ও মুক্তিসংগ্রামের একমাত্র পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজনীতির সর্বক্ষেত্রে তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সাফল্যের সঙ্গে। বাঙালি জাতি ভূষিত করল তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে।
বঙ্গবন্ধু রাজনীতির গৌরবমণ্ডিত অর্জন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বঙ্গবন্ধু হন সমগ্র বাঙালি জাতির পিতা। ৩০ লাখ শহিদ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ঊষালগ্নে তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। যত দিন একজন বাঙালি বেঁচে থাকবে, তত দিন তারা অর্জিত স্বাধীনতাকে বিপন্ন হতে দেবে না।
বাঙালিকে পরাধীন রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি পৃথিবীতে আর নাই।’ বাঙালি জাতির নিজস্ব ঠিকানা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের পর পরই তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা মানে একটি নিজস্ব পতাকা মাত্র নহে। জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ তিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও চেয়েছিলেন বাঙালি জাতিকে একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তার এ স্বপ্ন উচ্চারিত হয় তারই সুকণ্ঠে- ‘বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করে কোনো দেশ কখনও আত্মমর্যাদাপূর্ণ ও মহান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করতে পারে না।’
শুধু রাজনীতির সফল ব্যক্তি নয়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক নরম ও কোমল হৃদয়ের উদার মানুষ।
১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার সমাজতান্ত্রিক নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় কখনো দেখিনি। আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস ও ব্যক্তিত্বে এ মানুষটি হিমালয়ের মতোই উঁচু।’ বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিত্ব ও স্বদেশপ্রেম দ্বারা বিশ্বসভায় বাঙালিকে অত্যন্ত মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ব্রিটিশ মানবতাবাদী আন্দোলনের অগ্রনায়ক লর্ড ফেন্নার ব্রোকওয়ে একদা মন্তব্য করেছিলেন, ‘নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও আয়ারল্যান্ডের জর্জ ডি ভেলেরার চেয়েও মহান ও অনন্য।’ তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি একই সঙ্গে একটি স্বাধীন জাতি ও স্বাধীন ভূমির জনক।
বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরঞ্জীব- তার চেতনা অবিনশ্বর। বাঙালির অস্থিমজ্জায় মিশে আছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিবাদর্শে শাণিত বাংলার আকাশ-বাতাস জল-সমতল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চির প্রবহমান থাকবে।
পরাধীন, অবহেলিত ও নিষ্পেষিত এই জাতিকে শতাব্দীর মহানায়ক স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছিলেন। বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্নকে যিনি বাস্তবায়িত করেছিলেন, যিনি এই স্বাধীনতার স্বাদ বাঙালিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তিনি মহাকালের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সাধারণ মানুষ নন। তিনি এক মহানায়ক। মহানায়কের জন্ম একটি জাতিতে বারবার হয় না। মহানায়ক কখনও একাধিক হয় না। মহানায়কের কোনো তুলনা হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসে এক একটি জাতির জন্য এক একজন মহানায়কের জন্ম হয়েছিল। বাঙালি জাতির জন্যও বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল। বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আজও বাঙালি পরাধীনতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারত না।
বঙ্গবন্ধু আসলেই বাংলার সাধারণ মানুষের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে পেরেছিলেন। মুসলিম লীগের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে দুটি বিষয় কাজ করত। একটা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা এবং তাদের যে দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা; তা থেকে মুক্ত করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সাহসিকতা। অর্থাৎ সাহস করে মানুষকে আন্দোলনের পথে নিয়ে আসা। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলে যে সাহস ও দৃঢ় মনোবল দরকার, সেটা অর্জন করা। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতা, যুবনেতা এবং তিনিই আওয়ামী লীগের একজন নেতা, যিনি প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই সময়কার অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। মানুষের কাছেও তিনি দ্রুত পৌঁছে যেতে পারতেন।
বঙ্গবন্ধু হঠাৎ মহানায়কে পরিণত হননি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি মহানায়কে পরিণত হয়েছিলেন। কিশোর বয়সেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে তিনি প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। এর পর থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা। তিনি তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন ও বিস্তারেও তার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন।
মুক্তির যে অন্বেষা বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন লালন করেছেন তার মূলে ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বক্তৃতায় সেই স্বপ্ন উঠে এসেছে বারবার। ৭ মার্চের ভাষণে যখন তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন তখন তার নির্দেশনার মধ্যেও ছিল ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়’।
তিনি ছিলেন এমনই একজন নেতা যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের স্ফুলিঙ্গে তিমিরাচ্ছন্ন গগনে উদিত হয়েছিলো স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য এবং যার একটি ভাষণই ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এক মহা প্রলয় সৃষ্টি করেছিল যা এখন রীতিমতো বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। একটি বদ্ধ প্রকোষ্ঠে আটকে পড়া জাতিকে উদ্ধার করার জন্য এমন ভাষণ বিশ্বে বিরল। কৃমি কীটে খাওয়া দগ্ধ শাসন ব্যবস্থার বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছিল বাঙালি জাতি, আর এমনই এক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে আলোর স্ফুরণ ছড়িয়ে ছিল এবং বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে ঝংকার তুলেছিলো। অর্ধশত বছর আগে দেয়া সেই কালজয়ী ভাষণেই মুক্তির আস্বাদন পেয়েছিল বাঙালি জাতি। ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো এবং এমনই অনুপ্রেরণামূলক ভাষণ ছিল সেটি যা মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল এবং বুকের তাজা রক্ত দিতে বাঙালি ন্যূনতম কুণ্ঠাবোধ করেনি।
এইভাবে তার স্বপ্ন ও সংগ্রাম ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। কারণ শান্তি প্রতিষ্ঠায় এনে দিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত বিজয়। সেই দিনগুলোতে অনেকেই ভাবতে পারেননি যে, বাংলাদেশ খুব অল্প সময়ে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সহযোগী জাতীয় চার নেতা এবং অন্যান্য ব্যক্তি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন ও চেতনাকে ধারণ করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরিচালনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ। তাদের হৃদয়ে সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
এ দেশের দুঃখী-দরিদ্র মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর নিরন্তর, নিরলস সংগ্রাম এবং দাবি আদায়ে দীর্ঘ কারাবাসের মুখে দৃঢ় মনোবল তাঁকে করে তুলেছিল জীবন্ত কিংবদন্তি। একজন মহান, ত্যাগী নেতা তাঁর দেশের মানুষকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন, অপরিসীম সাহসিকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, সঠিক ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ছিনিয়ে আনতে পারেন, তার উজ্জ্বল উদাহরণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাহিত্যিক ও ছড়াকার অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুর কীর্তিকে স্মরণ করে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর লিখেছিলেন কালজয়ী পঙ্ক্তি- ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্তগঙ্গা বহমান/ তবু নাই ভয় হবে হবে জয়/ জয় মুজিবুর রহমান।’
স্বাধীনতার অগ্রদূত মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়; একটি ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা। স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বপ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা বাংলাদেশকে চূড়ান্ত স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। স্বাধীনতা ঘোষণা, প্রতিরোধ যুদ্ধ, সরকার গঠন, ছোট ছোট যুদ্ধ, বড় বড় যুদ্ধ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস এবং বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতন, গণহত্যাসহ নানাবিধ ঘটনা নিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে বঙ্গবন্ধু একটি শক্তি, একটি চেতনা। তিনি গোটা বাঙালি জাতির জন্য যে উপহার দিয়ে গেছেন, সেই ঋণ কখনও শোধ হবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার নামের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির আত্মপরিচয়। তিনি সেই মহান পুরুষ যাকে নিয়ে বাঙালির অহংকার কোনদিন শেষ হবে না। এমনই বিশাল ব্যক্তিত্ব তিনি মৃত্যুর প্রায় পাঁচ দশক পরও তাঁকে আবিষ্কার করতে হয় নতুনভাবে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। নতুন সূর্যালোকে সূর্যের মতো চির ভাস্বর উজ্জ্বল নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। মহানভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের প্রতিটি আন্দোলনে শেখ মুজিব ছিলেন অগ্রনায়ক। বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় একাত্তর, শ্রেষ্ঠ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ আর শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতির আত্মমর্যদার স্বীকৃতি, বাংলা ভাষার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি এবং বাঙালি সংস্কৃতির উদ্বোধনের সংগ্রাম। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মন্তব্য করেন “বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির পথ-প্রদর্শক ও মহান নেতা- বিশ্ব শান্তিরপ্রতীক।” বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি।
বাংলাদেশের মাটিতে মৌলবাদ বা পাকিস্তানিদের অপতৎপরতা যত বাড়বে তত দ্রুত বাঙালিকে আশ্রয় খুঁজতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে। সেই সঙ্গে আশ্রয় খুঁজতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে- যে মুক্তিযুদ্ধকে আমরা অন্তরে ধারণ করেছি পরম মমতা ও অহংকারে। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আমরা আমাদের শোকের সান্তনা ও সংগ্রামের সাহস পাই। তাই বাঙালিকে জানতে হলে, বাঙালির হাসি-কান্না আনন্দ বেদনাকে উপলব্ধি করতে হলে- আমাদের বার বার ফিরে যেতে হবে শেখ মুজিবের কাছে। এই মহানপ্রাণকে শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ কোন দলভুক্ত হবার প্রয়োজন আছে বলে, আমি মনে করিনা। হৃদয়ে যার বাংলাদেশ, যে বাঙালির হৃদয়ে দাসত্ব নেই, পরাধীনতা আর উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা নেই-সেই বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর অহংকারের।
তিনি আজ আমাদের প্রত্যাহিকতায় মিশে আছেন- মিশে থাকবেন জাতির অগ্রযাত্রার প্রতিটি অনুভবে-সাহস, শক্তি ও অনুপ্রেরণা হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে অনির্বাণ শিখার মত। এই ভাষণ ঘরকুনো নিতান্ত ছাপোষা বাঙালিকে রূপান্তরিত করেছিল বীরের জাতিতে। পশ্চিমা দেশের পর্যবেক্ষকরা তাঁকে চিত্রিত করেন ‘পোয়েট অব পলিট্রিক্স’ তবে শেখ মুজিব একই সঙ্গে ছিলেন ‘পোয়েট অব হিউমোনিটি অ্যান্ড জাস্টিস’। রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা, ব্যক্তিত্বের সম্মোহনী শক্তি, ত্যাগ ও আদর্শ তাঁকে পরিণত করেছে ইতিহাসের অপ্রতিরোধ্য বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ কিংবদন্তিতে।
কলকাতার ছাত্র জীবনে শেখ মুজিব থাকতেন ইসলামিয়া হোস্টেলে। সেই হোস্টেল সুপার, দর্শণ শাস্ত্রের অধ্যাপক এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা জগন্নাথ কলেজের বিখ্যাত অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান স্মতিকথামূলক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ছাত্র জীবনের একটি ঘটনার অভিযুক্ত মুজিব দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর সামনে। কিন্তু কৃতকর্মের সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা ও সরল স্বীকারোক্তি প্রদানের ব্যাপারে শেখ মুজিবের সৎসাহস ও ঋজুতা তাঁকে অভিভূত করেছিল। শেখ মুজিবের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও স্পষ্টবাদিতা বহুদর্শী অধ্যক্ষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের তরুণ বয়সের চারিত্রিক অবস্থান ও আত্মবিশ্বাসের কথা।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আইন পরিষদে ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানীরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকেই মেনে নেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ মুজিব তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের ধর্মঘট আন্দোলনের নেতৃত্বে যুক্ত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। শাস্তি হিসেবে এ ব্যাপারে জড়িত ছাত্রদের কে জরিমানা করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অনেকেই জরিমানার শাস্তি মেনে নিয়ে ছাত্রত্ব বজায় রেখেছিলেন, কিন্তু শেখ মুজিব তীব্র প্রতিবাদে এ আদেশ প্রত্যাখান করায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
১৯৫৫ সালে পাক- শাসকচক্রের ষড়যন্ত্রে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। তখনই পাকিস্তান গণপরিষদে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সেই পাকিস্তানি মনোবৃত্তির বিরোধিতা করে বলেছিলেন, “বাংলা শব্দটার একটা ইতিহাস আছে, আছে বাংলার ঐতিহ্য। এই নাম পরিবর্তন করতে চাইলে, সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে, তাঁরা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কিনা”। এরই অবিচল ধারাবাহিকতায়, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনাধীন অবস্থাতেও সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী সবাই ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ এ শেখ মুজিব বলেছিলেন, “জনগনের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।”
ঘাতকের বুলেট ‘স্বাধীনতার সূর্য’ বঙ্গবন্ধু নামের প্রদীপ নিভিয়ে দিলেও বাঙালির হৃদয় থেকে তাকে সরাতে পারেনি। একজন মানুষ মৃত্যুর পরেও যে কতটা শক্তিশালী, একটা জাতির কতটা জুড়ে থাকতে পারে তার উদাহরণ বঙ্গবন্ধু। কবির ভাষায়-‘আপনাকে তো নিয়েছে ওই ঘাসের নরম/কোল, জোৎস্নার কিছু শিশির প্রতি ভোরে/বাঁচিয়ে রাখে বাংলার রূপ, আপনি/অন্য মনে আছেন বলে আমরা/বলি, শেখ মুজিব ঘুমিয়ে আছেন/টুঙ্গিপাড়ায়;/বঙ্গবন্ধু, আপনার যখন সময় হবে/এসে ডাক দেবেন, সবাই আছে,/সোনার বাংলার স্বপ্নও আছে,/আছে কোটি কোটি জনতা,/‘ভায়েরা আমার’ বলে ডাকলেই/আমরা জয়ধ্বনি দিয়ে বলব,/জয় মুজিব, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা।’
পাকিস্তানিরা যে মুজিবকে হত্যা করতে পারেনি, তাঁকেই হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রে জড়িত কিছু বাঙালি বিপথগামী সেনারা। ঘাতকের উদ্যত বন্দুকের সামনে, অনিবার্য মৃত্যুর মুখেও সাহসী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুজিব। অবশ্যই বলা দরকার, পিঠে নয়, ঘাতকের গুলি লেগেছিল মুজিবের বুকেই। তবে নৃশংস প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকেরা জানতো না, তাদের অস্ত্র কখনো বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠকে স্তব্ধ করতে পারবে না। তাঁর বজ্রকণ্ঠ চিরকাল ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হবে, বাঙালির হৃদয়ে, হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের প্রাণের গহীনে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন আমাদের লাল-সবুজ পতাকার ক্যানভাস জুড়ে, প্রতিটি বাঙালির মানস পিতা- জাতির পিতা হয়ে। সংগ্রামী কবি সিকান্দার আবু জাফর তাঁর কবিতায় লেখেন-
“মুক্তিকামী মানুষের শুভেচ্ছার পথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসছেন বাংলাদেশে করতালি মুখরিত পথে।”
বঙ্গবন্ধুর সবুজ বাংলা, বঙ্গবন্ধু কন্যার সুনীল বাংলা, এই সবুজে সুনীলেই আজ আমাদের সোনার বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অগ্রসরমান বাংলাদেশের ইতিহাস এখন ‘নতুনদিনের ভোরে’। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৫ আগস্টের মতো ঘৃণ্যতম ও কলঙ্কজনক দিন আর নেই। প্রত্যাশা রাখি খুনিরা শাস্তি পাবেন আমরা হবো কলঙ্ক মুক্ত জাতি।
–লেখক
হাফিজুর রহমান
বিএসএস(রাষ্ট্রবিজ্ঞান)
নির্বাহী সম্পাদক
সাপ্তাহিক জনতার নিঃশ্বাস পত্রিকা।
Related News

প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ
জনতার নিঃশ্বাস::গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে সাপ্তাহিক জনতার নিঃশ্বাস, দৈনিক মুক্ত কাগজ সহ একাধিক পত্রিকায়Read More